পৃথিবীর বুকে যে যুগে প্রথম মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল সেই সময়ের আদিম মানুষের কথাবার্তা কিংবা ভাববিনিময় সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হাতের কৌশল এবং মুখাভিনয়ের মাধ্যমে মানুষ ভাববিনিময় করতে শুরু করে। এরপর ভাষা, শিল্প, সংস্কৃতির সূত্রপাত ঘটে। সমাজ, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, পিতা, পুত্র, স্ত্রী, কন্যা, মা এবং পরিবার নিয়ে গৃহী জীবনে অভ্যস্থ হতে থাকে মানুষ। গৃহী জীবনের মাধ্যমেই সমাজবদ্ধ হবার পাঠ অর্জন করে আদি মানুষ। সময় এগিয়েছে। মানুষও সেই সঙ্গে হয়ে উঠেছে সভ্য, ভদ্র, বিনয়ী, নম্র সুজন ও শিষ্টাচারী। তারমধ্যে ভালোবাসা, দয়াময়তা, করুণা, সহানুভূতি এবং মানবিকতা বোধের প্রতিফলন ঘটেছে ধীরে ধীরে।
আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় সৌজন্য এবং শিষ্টাচার।
সৌজন্য এবং শিষ্টাচার আভিধানিক অর্থে প্রায় একই অর্থ বহন করে অর্থাৎ সুজনোচিত লৌকিকতা বা ভদ্র-সভ্য ব্যবহার। তথাপিও যেখানে শিষ্টাচার নিছক ভদ্র আচার ও আচরণ, সেখানে সৌজন্য সুজন হৃদয়ের মহত্তম প্রকাশ।
সভ্যতা সৃষ্টির আদি লগ্ন হতেই মানুষ শিষ্টাচারী এবং সৌজন্যপূর্ণ ছিল না। শিক্ষা-সংস্কৃতির দীর্ঘ তপস্যার সিদ্ধি হল মানুষের এই দুর্লভ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। দীর্ঘ সাধনায় মানুষের মধ্যে একত্রিত হয়েছে এই দুই মহান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে মানুষ পৃথিবীর সর্ব জীবের সম্মুখে উন্মুক্ত চিত্তে উচ্চ শিরে ঘোষণা করতে পারে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। ব্যক্তিমানুষের সুজন ও শিষ্টাচার শুধু ঐ ব্যক্তিরই সুফল করে না, বরং সমগ্ৰ সমাজ তথা সমগ্ৰ সভ্যতার উন্নতি এবং উৎকর্ষতায় ত্বরান্বিত করে।
সুন্দর পোশাক যেমন দেহের শোভা প্রদর্শন করে, তেমনি সৌজন্য এবং শিষ্টাচার আত্মার মাধুর্য্য প্রকাশ করে। কিন্তু মানুষের দীর্ঘ সাধনার এই ফসল তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে একবিংশ শতাব্দীর এই যন্ত্র নির্ভর সভ্যতায়। ছাত্রকুল "সৌজন্য বোধ এবং শিষ্টাচার" সম্পর্কে পাঠ্যপুস্তকে বড় বড় রচনা মুখস্থ করছে এবং জ্ঞান অর্জন করছে বটে। কিন্তু তাঁর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে না। অর্জিত জ্ঞানের বাস্তবায়নে অক্ষম হচ্ছে যুবসমাজ। তারাই তো সমাজের এগিয়ে যাওয়ার ইঞ্জিন। মূল হাতিয়ার। এই যেমন পরীক্ষায় নম্বর পাওয়াটাই সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি। সেক্ষেত্রে সঠিক জ্ঞানলাভ অর্থাৎ কনসেপ্ট ক্লিয়ার ছাড়াই শর্টকাটে, সাজেস্ট অনুযায়ী পড়াশোনা করে নম্বর পাওয়ার সহজ উপায় রয়েছে। তাইই ঘটছে সমাজে। পরীক্ষার খাতা ভরে উঠছে ৯০%, ৯৫% কখনো বা ৯৯ কিংবা ১০০% নম্বরে।
আবার অসুস্থ বৃদ্ধ মানুষ রাস্তায় পড়ে থাকলেও ব্যস্ত সভ্যতা বাস, ট্রেন, ট্রাম ধরতে ব্যস্ত। নাহলে অফিস দেরী হয়ে যাবে। বসের চোখ-রাঙানি খেতে হবে।
অ্যাক্সিডেন্ট এর মতো ঘটনায় পীড়িতকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বদলে সেলফি তোলার তোড়জোড় বাঁধে কিংবা পীড়িত-এর চারিদিকে জড়ো হয়ে অপেক্ষা করা হয় সিনেমার নায়কদের মতো কেউ একজন আসবে তারপর সব ঠিক হয়ে যায়।
সহনশীল না হলে সৌজন্য এবং শিষ্টাচার-বোধ আসে না। অপরকে সম্মান দেবার প্রবৃত্তি সৃষ্টি হয় না। আলস্য হলো অসৌজন্য এবং ভ্রষ্টাচারের আঁতুড় ঘর। সত্যের পথিকরূপে অন্তরের স্বরূপকে প্রকাশ করে মানুষের সুজন ও সদাচারী হয়ে ওঠা সমাজের পক্ষে তথা সভ্যতার পক্ষে অতি প্রয়োজন। মহান ব্যক্তিদের জীবন এবং জীবনদর্শন এক্ষেত্রে পরিচালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। তাই মহান ব্যক্তিদের জীবনী পাঠ করা উচিত।
0 মন্তব্যসমূহ